ঢাকা, শুক্রবার, জুলাই ২০, ২০১২, শ্রাবণ
৪, ১৪১৯
(উপ-সম্পাদকীয়)
বুয়েট পরিস্থিতি
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দায় এড়াতে পারে কি?
মো. মুজিবুর রহমান
মাঝখানে কয়েক
মাস শান্ত থাকার পর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) আবার উত্তাল ও অশান্ত
হয়ে উঠেছে। দেশের অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী এ প্রতিষ্ঠান এখন নানামুখী সমস্যায়
জর্জরিত। ফলে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনেও দেখা দিয়েছে চরম
অনিশ্চয়তা।
বুয়েটে
অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির ধারাবাহিকতা সংক্ষেপে পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও
উপউপাচার্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অনিয়মের অভিযোগে তাদের পদত্যাগ দাবিতে গত ৭
এপ্রিল কর্মবিরতি শুরু করে শিক্ষক সমিতি। লাগাতার ২৮ দিন কর্মবিরতির পর ৪ মে
সমস্যা সমাধানে প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষকরা সাময়িকভাবে
কর্মবিরতি স্থগিত করেন। তবে দীর্ঘ দিনেও শিক্ষকদের দাবি মতে সমস্যার সমাধান না
হওয়ায় গত ৯ জুন সমিতির সভায় ৩০ জুনের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও উপউপাচার্যকে
পদত্যাগ করতে সময় বেঁধে দেয়া হয়। বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে উপাচার্য ও উপউপাচার্য
পদত্যাগ না করায় ৭ জুলাই থেকে প্রতীকী কর্মবিরতি চলে এবং ১৪ জুলাই থেকে লাগাতার
কর্মবিরতি শুরু হয়।
এদিকে
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আকস্মিকভাবে ৪৪ দিনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করার
পরিপ্রেক্ষিতে পরিস্থিতি আরও অচলাবস্থার দিকে মোড় নেয়। একপর্যায়ে শিক্ষক সমিতি
উপাচার্য ও উপউপাচার্যের পদত্যাগের পরিবর্তে তাদের অপসারণের দাবি উত্থাপন করে।
তাদের সঙ্গে যুক্ত হন শিক্ষার্থীরা। ফলে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে যায়। এরই মধ্যে
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বুয়েটের কয়েকজন সাবেক
উপাচার্য, অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের
নেতা, বিভিন্ন অনুষদের ডিন ও বিভাগীয় প্রধানদের
উপস্থিতিতে আলোচনা সভার আয়োজন করেন। আলোচনায় অংশ নেয়া প্রায় সবাই উপাচার্য ও উপউপাচার্যের
অপসারণের বিষয়ে মত দেন। তাদের অধিকাংশই সভায় অভিমত প্রকাশ করেন, এ দুজনকে স্বপদে রেখে সমস্যার সমাধান হবে না। শিক্ষামন্ত্রী আলোচনার বিষয়টি
প্রধানমন্ত্রীকেও অবহিত করবেন বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু উপাচার্য ও উপউপাচার্যের
অপসারণের কোনো সিদ্ধান্ত না আসায় শিক্ষকরা পদত্যাগের ঘোষণা দেন। ফলে বুয়েটের
সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে আরও জটিল আকার ধারণের আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।
শিক্ষক
সমিতির দাবি অনুযায়ী, রোববারের (২২
জুলাই ২০১২) মধ্যে উপাচার্য ও উপউপাচার্যকে পদ থেকে সরিয়ে দেয়া না হলে শিক্ষকরা
একযোগে পদত্যাগ করবেন বলে সংবাদমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। এ উদ্দেশ্যে শিক্ষকরা
পদত্যাগপত্রে সইও করে রেখেছেন। দৃশ্যত বুয়েটের পরিস্থিতি আরও ঘনীভূত হচ্ছে। এ
লেখাটি যখন বণিক বার্তায় ছাপা হবে তখন উপাচার্য ও উপউপাচার্য তাদের স্বপদে থাকবেন
কি না বা তারা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করবেন কি না কিংবা তাদের আপসারণ করা হবে কি না,
তা স্পষ্ট করে বলা মুশকিল। তবে অনুমান করা যায়, কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে অপসারণ করা না হলে তারা নিজেরা পদ ছাড়বেন না।
অন্যদিকে শিক্ষক সমিতিও তাদের দাবির ব্যাপারে অনড়। এতে বাড়ছে দ্বন্দ্ব ও সংঘাত।
বুয়েটের
পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত কোন দিকে মোড় নেয়, তা সময়ই বলে দেবে। কীভাবে সৃষ্ট জটিলতার অবসান করা হবে, তা কর্তৃপক্ষের বিষয়। তবে আমরা বেশি উদ্বিগ্ন শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা
নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন ধরনের দ্বন্দ্বের কারণে সাধারণ শিক্ষার্থীদের
পড়ালেখায় বিঘ্ন ঘটছে— এ দিকটি উপাচার্য, উপউপাচার্য ও শিক্ষক সমিতি
উপলব্ধি করতে না পারার কথা নয়। সংকট নিরসনে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে চেষ্টা
চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে শিক্ষামন্ত্রী ব্যক্তিগতভাবে উদ্যোগ নিয়েছেন সমস্যা
দ্রুত সমাধানের জন্য। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে কত দিন
লাগবে সেটাই আসল প্রশ্ন। উপাচার্য ও উপউপাচার্যের বিরুদ্ধে যদি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ
থেকে থাকে, তাহলে আইনসঙ্গতভাবেই সেটির সুরাহা হওয়া উচিত। শিক্ষামন্ত্রী
যখন সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছেন, তখন শিক্ষার্থীদের
পড়ালেখায় বিঘ্ন ঘটিয়ে শিক্ষক সমিতির পক্ষ থেকে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া কতটা যৌক্তিক— সে দিকটিও সমিতির নেতাদের ভেবে দেখতে
হবে। যদিও শিক্ষক সমিতি তাদের কর্মসূচি দুই দিনের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেছে বুধবার।
তবে এর মধ্য দিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে কি না, তা
নিশ্চিত নয়। মনে রাখা দরকার, যেকোনো কারণে শিক্ষার্থীদের
শিক্ষাজীবন বিঘ্নিত করার অধিকার কারও নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে অচলাবস্থা সৃষ্টির ফলে
সাধারণ শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন একদিকে প্রলম্বিত হয়, অন্যদিকে
অভিভাবকদের ওপর বাড়ে অতিরিক্ত ব্যয়ের বোঝা। অনেকের সরকারি চাকরিতে আবেদন করার বয়স
ফুরিয়ে যায়। এ পরিস্থিতি থেকে শিক্ষার্থীদের রেহাই দিতে হবে। কেন একটি ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে
সমস্যার সমাধান করতে এত সময় ব্যয় হচ্ছে— তা বোধগম্য নয়। এর পেছনে মূল রহস্য উদ্ঘাটন করে এমন ব্যবস্থা নেয়া
দরকার, যাতে অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন পরিস্থিতির
পুনরাবৃত্তি না ঘটে। মোট কথা, আমরা শিক্ষার্থীদের নিরাপদ
ও নির্বিঘ্ন শিক্ষাজীবন চাই।
যেকোনো
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন কারণে সমস্যা দেখা দিতেই পারে। সমস্যার সমাধানও নিশ্চয়ই
রয়েছে। যৌক্তিক দাবি আদায় করতে হলেও শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় কোনো বিঘ্ন ঘটানো
সমীচীন নয়। শিক্ষকরা চাইলে পড়ালেখার কাজ চালিয়েও ক্লাসের পর আন্দোলন অব্যাহত রাখতে
পারেন। যদি এমন উদাহরণ সৃষ্টি করা যায় যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেকোনো আন্দোলনই হোক না কেন, শিক্ষার্থীদের স্বার্থে ক্লাস পরিচালনায় কখনো বিঘ্ন ঘটানো হবে না;
তাহলে তা বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হবে।
শিক্ষকরা কি পারেন না ক্লাস পরিচালনা অব্যাহত রেখে তাদের দাবি আদায়ে আলোচনা চালিয়ে
যেতে? বুয়েটে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হঠাৎ করেই
হয়নি। অনেক আগে থেকেই সংকট দেখা দিয়েছে। তাহলে উপাচার্য ও উপউপাচার্য কি সংকট
নিরসনের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারতেন না? শিক্ষক
সমিতির সঙ্গে তাদের কিসের এত বিভেদ? তারাও তো শিক্ষক।
তারা নিশ্চয়ই জানেন, আলোচনার মধ্যেই সমস্যার সমাধান
রয়েছে।
এখানে উল্লেখ
করা প্রয়োজন, শুধু অস্থিতিশীল
পরিবেশ বুয়েটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। দেশের আরও কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন
কারণে অস্থিরতা বিরাজ করছে। ফলে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ
নেই। নিকট অতীতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া পরিস্থিতি স্মরণ করলে দেখা
যায়, সেখানেও পরিবেশ স্বাভাবিক করতে সরকারকে হস্তক্ষেপ
করতে হয়েছে এক পর্যায়ে গিয়ে। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খ্যাতিমান এক শিক্ষককে
উপাচার্য পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়েও এখন উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন নিয়ে
অস্থিরতা বিরাজ করছে। শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ফিরে যাচ্ছেন, ক্লাস হচ্ছে না। আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে, কোনো
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যদি সারা বছরই অস্থিতিশীল পরিবেশ বিরাজ করে তাহলে সেখানে
শিক্ষার্থীরা ভালোভাবে পড়ালেখা করবেন কীভাবে? বিশ্ববিদ্যালয়ে
স্থিতিশীল ও শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করার দায়িত্ব কার? শিক্ষকদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণেও অনেক সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে
অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। কেন শিক্ষকদের কারণে শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ পোহাতে হবে?
স্বাভাবিক শিক্ষাজীবনের যদি নিশ্চয়তা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে না
পাওয়া যায়, তাহলে যাদের অর্থ-বিত্ত আছে তারা পাড়ি জমাবেন
বিদেশে, আর যাদের অর্থ নেই তারা করবেন কী? এভাবে দেশের জন্য দক্ষ ও উপযুক্ত নাগরিক তৈরি সম্ভব? এমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে কি বাংলাদেশ সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারবে?
এসব প্রশ্নের সুরাহা জরুরি।
বিশ্ববিদ্যালয়ে
যত ঘটনাই ঘটুক না কেন, এর দায়ভার
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কিছুতেই এড়াতে পারে না। ধারণা করি, যেকোনো পরিস্থিতির পেছনে কোনো না কোনো স্বার্থ কাজ করে। এক দল ঘটনা
ঘটায়, অন্য দল তা সামাল দেয়ার চেষ্টা চালিয়ে যায়। এর
মাঝখানে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পোহাতে হয় চরম দুর্ভোগ। অনিশ্চিত হয়ে ওঠে তাদের
শিক্ষাজীবন। অভিভাবকরা থাকেন উদ্বেগের মধ্যে। এমন শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে
উত্তরণের উপায় কী?
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, সরকারি
টিচার্স ট্রেনিং কলেজ
mujibur29@gmail.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন